পুরাতন বৎসরের জীর্ণ ক্লান্ত রাত্রি কেটে গিয়ে আজ পয়লা বৈশাখে নববর্ষের শুভারম্ভ। তবে শুধু নববর্ষ বললেই হয় না, তার একটা বিশদ ব্যাখ্যা লাগে–কোন নববর্ষ, কাদের নববর্ষ। যদি বলি বাঙালির নববর্ষ, তাহলেও বিভ্রমের একশেষ। কেননা ভাগ হয়ে গেছে বিলকুল। এমনকী পঞ্জিকা গণনাতেও।ফলে এপ্রিলের একদিন যদি হয় পশ্চিমের নববর্ষ, তাহলে তার আগের দিন পূবের নববর্ষ। আগে বাসি বিয়ের কথা শুনেছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে,বাসি নববর্ষও রয়েছে।মাঝে মাঝে আবার গ্রহচক্রের ষড়যন্ত্রে একই দিনে দুই বঙ্গের নববর্ষের গলাগলি। যেমন এই বছর।চোদ্দশো একত্রিশ সালে।
বাঙালি কবি বলেছেন, এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা। সার সত্য হল বঙ্গ ভঙ্গদেশ হওয়া সত্ত্বেও রঙ্গের কোনও শেষ নেই।তাই বৃহৎ বঙ্গে মিল, অমিল ও গরমিলের প্রকোপে রঙ্গ বেশ ভালো জমে ওঠে।
পয়লা বৈশাখের নববর্ষ অবশ্য বাঙালির একান্ত নয়। ভারতের অন্যান্য স্থানেও পয়লা বৈশাখ হ্য়।
যেমন পাঞ্জাবে বৈশাখী,অসমে বিহু, মনিপুরে শিলহেনবা, কেরলে বিষু। তবে ওসব তর্কবিতর্ক ছেড়ে যদি বলি বাঙালি নববর্ষ, তাহলেও খটকা থেকে যায়।বর্তমান বাঙালির উৎসবে আড়ম্বরের বহর দেখে মনে হয়, বাঙালির জীবনে দুটো নববর্ষ– বিশ্বায়নের ইংরেজি নববর্ষ এবং বঙ্গায়নের বাঙালি নববর্ষ।ইংরেজি নববর্ষে আমরা একটু সাহেবি স্টাইলে হ্যাপি হ্যাপি মেজাজে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন। আর বাংলা নববর্ষে বাঙালি মেজাজি আমরা বলি ‘শুভ নববর্ষ’। তবে বাঙালিত্ব নিয়েও পূব-পশ্চিমে লড়াই বেশ জমে উঠেছে। ঠিক খিলখিল্লির মুলুকেতে যেমন জমে উঠেছিল ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’। পদ্মাপারের দেশ পাকিস্তানে আত্মবিলোপের পরে নব-অবতারে বাংলাদেশের উদ্ভবে বাঙালিত্বের একছত্র দাবিদার। তারা পশ্চিমবঙ্গের লোককে বলছে ‘ইন্ডিয়ান’, কেননা পূর্ববঙ্গে পশ্চিমবাংলা বলে কোনও কথা নেই,আছে ইন্ডিয়া।
এদিকে গাঙ্গেয় ভূমিপুত্ররা তাঁদের কবির কথায় বলেছেন, ‘মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে, আমরা বাঙালি বাস করি সেই তীর্থে বরদ বঙ্গে’।তাছাড়া ‘যুক্তবেণী’তে অবাঙালি আর ‘মুক্তবেণী’তে বাঙালি এমন কথায় এলাহাবাদের বাঙালিরা আপত্তি করতে পারেন। আর তাও স্বীকার করে নিয়ে এই মুক্তবেণীতে বাঙালি আর পদ্মাপারের বিশুদ্ধ বাঙালভূমির উল্লেখ করলে ‘লড়কে লেঙ্গে বাঙালিস্তান’ বলে আবার আরেকটা ধুন্ধুমার লেগে যেতে পারে। সে না হয় সা্র্ক-এর সাব-কমিটির উদ্যোগে একটা গঙ্গা-পদ্মা (বর্ণানুক্রমিক ধারায় আগে পিছে)সম্মেলন করে তার একটা বিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু এই যে বিদেশ বিঁভুয়ে বছরে বছরে যাঁরা বেঙ্গলি কনফারেন্স করছেন তাদের কী অবস্থা হবে? এইসব ঘরজ্বালানে পরভোলানে দেশত্যাগীকে কি আদৌ বাঙালি বলা সঙ্গত হবে? ইংরেজি আপ্তবাক্য অনুযায়ী ‘ওয়ান্স এ বেঙ্গলি, অলওয়েজ এ বেঙ্গলি’ মেনে নিয়েও কিছু সন্দেহ থেকে যায়। কেননা অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় এ বাঙালি সে বাঙালি নয়।
ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে যদি বাঙালিকে নির্দিষ্ট করতে হয় তাহলেও মুশকিল আসানের সম্ভাবনা কম। একই ইংরেজি ভাষা বললেও কেউ হচ্ছেন ব্রিটিশ, কেউ আমেরিকান, কেউ অস্ট্রেলিয়ান, কেউ কানাডিয়ান। তাদের সকলকেই কিন্তু ইংলিশ বলা যাচ্ছে না। আবার সাংবাদিক খুশবন্ত সিং তার মাতৃভাষা ইংরেজিতে বললেও তাঁকে কেউ ইংলিশম্যান বলে না। আমাদের কেতাদুরস্ত ইংরেজি লেখকদেরও কেউ ইংরেজ বলে স্বীকার করে না। তাঁদের পরিচয় বড়জোর ইন্দো-অ্যাংলিয়ান লেখক। সিস্টার নিবেদিতা, সিস্টার ক্রিস্টিন বা মাদার টেরিজা বাংলায় বাক্যালাপ করতেন। কিংবা ফাদার দ্যতিয়েন, উইলিয়াম রাডিচে বা মার্টিন কেম্পচেন বাংলা সাহিত্যের চর্চা করতেন। তবে এঁদের বাঙালি বলা বিধেয় কিনা সেকথা ভেবে দেখতে হবে। আবার যে সমস্ত বাঙালি সন্তান বিদেশ বিভুঁয়ে থকে বাংলায় স্পিকটি নট অবস্থায় বসবাস করেন, তাঁদের ‘আমরা বাঙালি’ গোষ্ঠীর মধ্যে ধরা যাবে কিনা, সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, বাংলা বললেই বাঙালি হওয়া যায় না। বাংলা ভাষাভাষীরা দেশে এবং বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ বাংলাদেশি, কেউ পশ্চিমবঙ্গবাসী, কেউ অসমীয়া, কেউ ত্রিপুরী, কেউ ঝাড়খন্ডি, কেউ আন্দামানি, কেউ হিন্দুস্তানি, কেউ ব্রিটিশ, কেউ আমেরিকান, কেউ কানাডিয়ান, কেউ জার্মান প্রভৃতি। জাতিসংঘে হেন দেশ নেই, যেখানে বাংলা ভাষাভাষী নেই। তাঁরা সবাই যদি ‘আমরা বাঙালি হচ্ছি’ বলি, তাহলেই বাঙালিবরণ করতে হবে, এটা কোন কথা হতে পারে না। শতধাবিচ্ছিন্ন ভূখণ্ডের বিচারেও বাঙালিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
নৃতাত্ত্বিক বিচারে যে মাথার খুলি মেপেজুপে কিংবা রক্ত পরীক্ষা করে বাঙালির ধরনধারণ নির্দিষ্ট করা যাবে তার উপায় নেই। কেননা জাত বেজাতের বিমিশ্রণে বাঙালি অবয়বে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম -এর কার কী অবদান, তা পন্ডিতরা তর্ক করে আজও স্থির করতে পারেননি। এমনকী যে কালায় ধলায় পার্থক্য গান্ধিজিকে একদিন ব্যাকুল করেছিল, সেই কলাধলার এমন সুন্দর সহাবস্থান আর কোথাও বড় একটা দেখা যায় না। বড় ভাইকে যদি মনে হয় কালকেতুর বংশধর তাহলে ছোটবোন যেন গ্রিসিয়ান মিরান্দা। জ্যাঠামশাই যদি হন শালপ্রাংশু মহাভূজ তো ছোটকাকা সাক্ষাৎ বামন অবতার। অর্থাৎ এই রূপের বৈচিত্র এবং রক্তের বিমিশ্রতা দিয়ে বাঙালি নির্ণয় করা দুঃসাধ্য।
ধর্ম দিয়েও বাঙালিকে ধরা মুশকিল। বাঙালির এই ধর্মীয় হেঁয়ালিটা ধরতে না পেরেই লালন ফকির বলেছিলেন, ‘বামুন চিনি পৈতে দিয়ে বামনি চিনি কেমনে?’ এক ধর্ম এক দেশ না হওয়ায় এখানে ধর্মী, বিধর্মী, অধর্মীর পাশাপাশি প্রাবল্য। যেমন আরব দেশ বললেই বোঝা যায়, এটি মোমিন মুসলমানদের দেশ। কিন্তু বঙ্গ ভাষাভাষীদের মধ্যে কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম বা অধর্ম দেখা যায় না।যদিও অবয়ব এবং রক্তের জগাখিচুড়িতে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন তফাত নেই, কিন্তু ধর্মমতের ভিন্নতার ছড়াছড়ি। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান এবং বামমার্গী তান্ত্রিক ও নিরীশ্বরবাদীরা – এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায় দেখ। একদিন ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গ বিভাগ হল। এক দিকটা হল পাকিস্তানের মুসলমানদের দেশ অন্য দিকটা হল সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশ। কিন্তু তাতেও মারামারি শেষ নেই। সুতরাং কোন এক বিশেষ ধর্ম দিয়ে বাঙালিকে চিহ্নিত করা মুশকিল।
খাওয়া-দাওয়ার কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। কেননা ‘ভিন্নরুচির্হি লোকাঃ’।একদল লোক যদি নিরামিষাশী তো দ্বিতীয় দল মৎস্যাসি। আবার অন্য দল মাংসাশী। একজনের যদি গব্য মাংস অখাদ্য হয়, অন্যদের বরাহ মাংস অখাদ্য।যাঁরা ‘ইয়ং বেঙ্গল’দের মতো প্রকাশ্যে খেতে পারেন না, তাঁরা গোপনে প্রায়ই ডুবে ডুবে জল খান। তবে সুখের বিষয়, আধুনিকতার প্রকোপে বঙ্গজরা এখন সর্বভুক হয়ে উঠেছেন। মাছ-ভাত বা তেঁতুল পাতার ঝোল খাওয়া বাঙালির দিন শেষ। চাইনিজ- চৌমিন, মোগলাই-রোল পাঞ্জাবি তন্দুর-তড়কা দক্ষিণী সম্বর-ধোসা ও কাশ্মীরি আলুর দম— সবকিছুই এখন তাদের ভক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
পোশাক-আশাক দিয়েও বাঙালি নির্ধারণ করা দুরূহ। হ্যাট-কোট দিয়ে যেমন ইউরোপীয় বোঝা যায়, শ্বেতশুভ্র আলখাল্লা দিয়ে আরবি শেখ, গেরুয়া বসন দিয়ে সন্ন্যাসী– তেমনি বাঙালির কোনও বিশেষ পোশাক আছে বলে মনে হয় না। একসময় আটহাতি ধুতি ও ফতুয়া বাঙালির সাধারণ বেশ বলে গণ্য হত। তারপর সাহেব বাঙালির কোট-প্যান্ট, জেন্টু বাঙালির ধুতি-পাঞ্জাবি, মুসলমান বাঙালির কুর্তা-পায়জামা যা সাধারণভাবে বাঙালি বেশ বলে গণ্য হত- এখন বিশ্বায়নের ফলে সেসব একাকার।লুঙ্গি ও ফতুয়া যদি বাজার করার পোশাক হয়, তাহলে প্যান্ট-শার্ট কিংবা পায়জামা-পাঞ্জাবি এখন ন্যাশনাল ড্রেস হয়ে উঠেছে। তবে গ্রামে-গঞ্জের শুদ্ধাচারী দাখিপিসির বয়কাট ছাঁট ও গামছাপরা বেশ, আধুনিকতার মোড়কে ফিরে আসতে বেশি দেরি নাই। বিয়ে করতে গিয়ে এখনও পুরোহিতের সঙ্গে যে বেল্টবাঁধা ধুতি-পাঞ্জাবি কিংবা শেরওয়ানি ও শাড়ির বাহার চলছে বটে,তবে সেটিও অন্তর্হিত হয়ে একাকার হলে বাঙালি বিশিষ্টতার আরেকটি পরিচয় পাওয়া যেতে পারে।
তবে বাঙালি কে চিনতে গেলে অনুসরণ করা যেতে পারে কবির সেই বাণী— কোটি কোটি সন্তানেরে হে বঙ্গ জননী, ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’। তাহলে দেখা যাচ্ছে মনুষ্য পদবাচ্য না হওয়াটাই বাঙালির প্রধান লক্ষণ। পন্ডিতেরা বলেন, বাঙালি নাকি স্বভাব বামপন্থী। বাঙালি একদিন বামাচারি তান্ত্রিক কাপালিক ছিল বলে জানা যায়, এখন যেটির আধুনিক সংস্করণে হয়েছে বামপন্থী বাঙালির উদ্ভব। এই বামপন্থার মহৎ গুণ, যা কিছু জীর্ণ পুরাতন তার নিঃশেষ করে নতুনের অভ্যুদয় ঘটানো। তাই এখন আমাদের সাধনা হলে অতীতের ভস্মস্তূপের উপর নবীনের মঠ নির্মাণ।
সেই গৌড়রাজ শশাঙ্কের আমলে বাঙালির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য রূপ পরিগ্রহ করার সময় থেকে বাঙালিদের যে শৌর্যশালী, মননশীল, সৃষ্টিশীল, মুক্তচিন্তার অধিকারী, জ্ঞানান্বেষী,অধ্যাত্মবাদী, জীবনরসিক গৌড়িয়া পরিচয়ের অভ্যুদয় ঘটেছিল, তার দিন শেষ। কেননা সেগুলি ছিল বাঙালির প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণাবর্তের ফসল। আধুনিক প্রগতিশীল বামাবর্তে কিন্তু বাঙালির মুক্তির একটাই পথ, সেটা হচ্ছে একমুখী চিন্তার গন্ডালিকাপ্রবাহ।কিন্তু যতদিন মেরুদণ্ড বজায় থাকে, ততদিন সেটি সুচারুরূপী সমাধা করা যায় না। তাই এখনকার কর্তব্য হল, মেরেকেটে সকলকে মেরুদণ্ডহীন করে তোলা। কেননা মেরুদণ্ডহীন অমানুষ হতে পারলে বাঙালি চরিত্রের হানি হওয়ার আর কোনও সম্ভাবনা নেই। ভুল বোঝারও আর কোন অবকাশ নেই।
অঙ্কন : দেবাশীষ দেব